ফেলে আসা মানুষগুলো: হারানো মুখগুলোর স্মৃতি
20240424
Asiqur Rahman Milon
কিছু মানুষ আসে, কিছু স্মৃতি যায়—জীবনের এই নির্মম সত্যিটা বুঝতে বুঝতে একদিন আমরা নিজেরাও হারিয়ে যাব। কতজনকে হারিয়েছি, কতজনকে মনে পড়ে রাতের অন্ধকারে যখন দু চোখে ঘুম আসে না। তাদের মুখগুলো চোখের সামনে ভাসে, কণ্ঠস্বর কানে বাজে, কিন্তু স্পর্শের বাইরে—চিরতরে।
যাদের ছায়া এখন শুধুই স্মৃতি
আমার ছোট আন্টির বড়, যিনি আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মানুষগুলোর একজন।এইটা শুধু আমি বলি না আমার আত্মীয় স্বজন ও বলে আমাদের মধ্যে নাকি সেই সব থেকে দেখতে সুন্দর ছিলো। কথায় কথায় হাসতেন, আদর করতেন।যিনি আমাকে সবচেয়ে বেশি সময় দিতেন, আদর করে "আশু বাবা" বলে ডাকতেন। তাঁর ডাক থেকেই আমার নাম "আশিক" ঠিক হয়েছিল। তাঁর কোনো স্মৃতি মনে নেই, শুধু মনে পড়ে সেই দিন—যখন তাঁর লাশ নিয়ে আসা হচ্ছিল, আমার বড় মামার মুখে যে বেদনার ছাপ দেখেছিলাম... আমি যখন কিছুই বুঝতাম না, তখনই তিনি চলে গেলেন।
তারপর আমার ফুফাতো বোন জোসনা আপু —দিনভর স্কুল নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও একসাথে বসে গল্প করতাম। একটা মেয়ে যার বয়স ক্লাস নাইনে, ধুঁকে ধুঁকে ব্লাড ক্যান্সারে মারা গেল। আমার চোখের সামনেই সে ধীরে ধীরে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
এক বছরের মধ্যেই তার ছোট বোন সুমি—ক্লাস ফাইভের সেই চঞ্চল মেয়েটি কী মায়াবী গলায় গান গাইত!এখনও কানে বাজে সেই সুর হঠাৎ করেই চলে গেল। বিশ্বাসই হচ্ছিল না, এতটাই অবাক করা মৃত্যু!
যে হারানোর ব্যথা ভাষায় ধরা যায় না-
তারপর এল সেই দিন—যেদিন আমার দুনিয়া চলে গেল। আমার আব্বা। তাকে নিয়ে লিখতে গেলে শব্দ হারিয়ে যায়, বুক ফেটে যায়। তিনি ছিলেন আমার স্বপ্ন, আমার ভরসা, আমার সবকিছু। তারপরও তাকে হারালাম।তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে গেলে বুক ভার হয়ে আসে তাই আর কিছু লিখতে পারলাম না ।ভালোবাসি বাবা তোমায় আমার জীবনের থেকেও বেশি।
গ্রামের সহজ সরল মানুষজন না থাকা -
তারপর গফুর দাদা—যার সঙ্গে ফজরের নামাজে যেতাম। ছোটবেলায় ভয় পেতাম, তাই তিনি ছিলেন আমার নামাজের সঙ্গী। তারপর একে একে চলে গেলেন মোবারক মুন্সী, আব্বার খালা-খালু আমির কাকার মা বাবার কথা বলতেছি তাদের জীবনযাপন ছিল কবিতার মতো সুন্দর। শেষ বয়সে আমি নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নিতে যেতাম। আব্বা নানা রকম জিনিসপত্র দিয়ে পাঠাতেন তাদের জন্য, সাত্তার কাকার মা, নানার দুই বোন—উনারা নানার বাড়িতেই থাকতেন তাই তাদের সাথেও অজস্র স্মৃতি জড়িয়ে আছে ।
গ্রামের বেল্লাল আঙ্কেল, রাসেলের বাবা—যিনি আমাকে "আঙ্কেল" বলে ডাকতেন আর বলতেন, "আঙ্কেল, তুমি বড় হয়ে নায়েক হবে। দেখতেই তো নায়েকের মতো!" কী সহজ-সরল মানুষ ছিলেন! সাক্কু ভাইও ছিলেন তেমনই—খাটোখাটো দেখতে, কিন্তু কথাবার্তায় প্রাণবন্ত।উনারা ঢাকায় থাকতেন, আব্বার খুব প্রিয় মানুষ—তারাও চলে গেলেন। আলকাছ কাকার মা, যাকে ‘দাদি’ বলে ডাকতাম, তার মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল। তারপর আব্বার বেস্ট ফ্রেন্ড, স্থলকেশী গ্রামের সেই কাকা—নামটা এখন ভুলে যাচ্ছি—আক্তার কাকা সেও চলে গেল।আক্তার কাকা, যিনি আমার স্কুলের পাশেই ব্যবসা করতেন, আব্বা উনার মাধ্যমে আমার পড়াশোনার খোঁজখবর নিতেন নিয়মিত। দানবীর দেনায়েত আলী কাকা—সহজ-সরল মানুষটিও নেই এখন।
যাদের নামাজের সুর এখন শুধুই স্মৃতি
মসজিদে করিম ফকির, লুৎফর ভাই-লুৎফর ভাইয়ের কথা না বললেই নয়—কী সুন্দর কবিতা লিখতেন! তাঁর বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল, পঁচু মন্ডল, নাসিরের দাদা, আক্তার ভাই—যার মধুর কণ্ঠে আজান শুনতাম সবাই চলে গেছেন। আমাদের ইমাম ইউনুস মুন্সীও নেই। তারপর ইব্রাহিম দাদা, বায়েজিদ মামার বাবা সবাই একে একে বিদায় নিলেন।
যে ভালোবাসা এখন শুধুই দুয়া
নবাব আলী মাস্টার—আমার নানা। নানা তো ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তি। কয়লার ইস্ত্রি দিয়ে কাপড় ইস্ত্রি করা, মঞ্চে নাটক করা, লেখালেখি, নির্দেশনা দেওয়া সবই করতেন। পারফিউমের গন্ধে রাস্তা মাতিয়ে রাখতেন। সে ডাকলে বি.সি.এস ক্যাডারও বসে থাকতেন। এত স্মার্ট, এত প্রাণবন্ত মানুষ—তিনিও চলে গেলেন। তারপর কেরামত মামা ও চলে গেলেন অল্প কিছু দিনের ব্যাবধানে।
আমার দাদা—যিনি যদিও আমার কাজিনদের আমার থেকে বেশি সময় দিতেন, তবুও তার থাকাটা বাড়িটাকে প্রাণবন্ত রাখত।
আমার দাদি—যিনি আমাকে ‘ভাই’ বলে ডাকতেন। আমিও বড় বোনের মতো দেখতাম যেহুতু আমার বড় বোন নাই যদিও আমার বড় বোন না থাকলেও শাবানা আপা, মিনা আপা আমার কাজিন হওয়া সত্ত্বেও আপন বড় বোনের মতোই আছে থাকে । দাদির আঁচল ধরে আমার জন্য আল্লাহ তালার কাছে দুয়া চাওয়ার সেই দৃশ্য কখনও ভুলব না। দাদির দুয়া আমার সঙ্গে ছিল, আছে, থাকবে।
তারপর সবশেষে ,সাত্তার মাস্টার কাকা যিনি আমাকে শাসন করতেন, বকতেন, ভয়ও পেতাম, সম্মানও করতাম তিনিও চলে গেলেন।
জীবনের নির্মম সত্য: সবাইকেই একদিন যেতে হবে
জীবনের মাঝপথে এসে হিসাব করি কতজনকে হারালাম! একদিন আমরাও চলে যাব। তখন কারা আমাদের মনে রাখবে? কারা আমাদের জন্য দুয়া করবে?
আরো অনেকেই চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। যদি কারো নাম লিখতে ভুলে গিয়ে থাকি, ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবে।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন। যারা চলে গেছেন, তাদেরকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন। আর আমরা যারা আছি, তাদেরকে সঠিক পথে চলার তাওফিক দিন। আমিন।
কী করা উচিত আমাদের?।
দুয়া ও ইসালে সাওয়াব:
তাদের জন্য নিয়মিত দুয়া করো, সদকা দাও, ভালো কাজ করো—যাতে তাদের আখিরাতের পথ সুগম হয়।
যারা আছে, তাদের মূল্য :
আজ যারা জীবিত আছে, কাল তারা হয়তো থাকবে না। তাদের ভালোবাসা ,সময় দেয়া খুব জরুরি ।
"প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।" (সুরা আল-ইমরান, ৩:১৮৫)
Writer
0 Comments